আপনি ছবি তোলেন, না ফটোগ্রাফি করেন? — তমোজিৎ বর্ধন

আপনি ছবি তোলেন, না ফটোগ্রাফি করেন? — তমোজিৎ বর্ধন




আপনি ছবি তোলেন, না ফটোগ্রাফি করেন?
“আমার ডিএস‌এল‌আর নেই”, “বাবা আইফোন কিনে দিচ্ছে না”, “আমার বাড়ির কাছে পাহাড় বা সমুদ্র নেই”, “আমার কোনো মডেল বন্ধু নেই”, অথবা “চাকরি, সংসার সামলে আর ফটোগ্রাফি করা হয়ে ওঠে না”, “আজকাল আর ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয় না, তাই ফটোগ্রাফি-ও করা হয় না”— অজুহাত দিতে চাইলে তার শেষ থাকে না। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে আজ আমরা প্রত্যেকে পকেটে ক্যামেরা নিয়ে ঘুরি। আজকের যে কোনো স্মার্টফোন যথেষ্ট সূক্ষ্মতার সঙ্গে ছবি তুলতে সক্ষম, আর আমরা তা দিয়ে দিনরাত ছবিও তুলছি। কিন্তু সেই ছবিকে আমরা “ফটোগ্রাফি” বলতে সাহস পাই না। দামি ক্যামেরা, লম্বা-লম্বা লেন্স, এসব না থাকলে কি আর ফটোগ্রাফি হয়? ফটোশপে ঘষে মেজে ঝাঁ-চকচকে ছবি তৈরি করতে না পারলে সেটা কি আর ফটোগ্রাফি হল?

প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জন করার দৌড়ে আমরা সাময়িকভাবে জিততে পারি, কিন্তু আরো পঞ্চাশজনের সেখানে পৌঁছতে বিশেষ সময় লাগে না। এই দৌড় বিজ্ঞানের সমকালীন অবস্থার দ্বারা সীমিত, আর সীমিত আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের দ্বারা। তাহলে ফটোগ্রাফি কি শুধু তাদের জন্য, যাদের বিরাট আর্থিক ক্ষমতা, যাদের বসবাস পাহাড়-পর্বতে বা সমুদ্রের উপকূলে, বা যারা ঘনঘন দেশে বিদেশে ঘুরতে যেতে পারে?

না।

ফটোগ্রাফি তথ্য আদান প্রদানের একটি মাধ্যম মাত্র। এর উপর কারও কোনো অধিকার নেই। ম্যানুয়াল সেটিং ব্যবহার না করলে, বা রুল অফ থার্ড্‌স না মানলে সেটা ফটোগ্রাফি নয়, এই কথাটির কোনো যৌক্তিকতা নেই। পাশ্চাত্যের চিত্রাঙ্কনের নিয়ম নীতি অনুসারে ফটোগ্রাফির এইসব নিয়ম তৈরি করা হয়েছে। অজন্তার গুহাচিত্র কি সেই সব নিয়ম নীতি মেনে আঁকা হয়েছিল? সেই ছবি কি খারাপ? সেই ছবিকে কি ইংরেজিতে “পেইন্টিং” বলা চলে না? তবে সেই সব নিয়ম না মেনে ছবি তুললে সেই ছবি তোলাকে “ফটোগ্রাফি” বলতে আমরা সংকোচ বোধ করি কেন? অজন্তার গুহাচিত্রের মূল্য যতটা তার সৌন্দর্যে, তার খুঁতহীনতায়, তার চেয়েও বেশি মূল্য তার কাহিনীতে, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্যে।

আমার বন্ধুরা যখন ক্যামেরা কেনার জন্য আমার পরামর্শ চায়, আমি তাদের কম দামের সহজ ক্যামেরা কেনার কথা বললে তারা বিরক্ত হয়। তারা মনে করে আমি তাদের আর্থিক ক্ষমতা এবং শিল্প দৃষ্টি দুটিকেই অস্বীকার করছি। দু-তিনটে খটোমটো নামের লেন্স সাজেস্ট না করলে তারা ভরসা পায় না। অন্তত পঞ্চাশ-ষাট হাজার টাকা খরচ না করলে ক্যামেরা কেনা হয় না।

যে মুহূর্ত ধরার জন্য ফটোগ্রাফি করা, প্রযুক্তির বাহুল্যে আর কম্পোজিশনের ঘনঘটায় সেই মুহূর্ত আর উপলব্ধি করা হয় না। ফটোগ্রাফি স্মৃতি ধরে রাখে না, ফটোগ্রাফি শুধু একটি ছবি তৈরি করে। আমরা যখন সেই ছবিটি দেখি, আমাদের স্মৃতির ভান্ডার থেকে সেই মুহূর্তটিকে বের করে আনে সেই ছবিটি। কিন্তু সেই মুহূর্তে তো আমরা ক্যামেরার কলকব্জা নাড়তে ব্যস্ত, আমাদের স্মৃতির ভান্ডার তো শূন্য।

আমার বাড়ির অ্যালবামে যেই সব ছবি আছে সেগুলি বেশিরভাগই আমার বাবার তোলা, আর কিছু আমার মা’র তোলা। তাঁরা ছবি তোলার কোনো নিয়ম জানতেন না, বা তাঁদের কাছে কোনো দামি ক্যামেরাও ছিল না। তাঁরা জানতেন— যার ছবি তোলা হচ্ছে, ক্যামেরায় চোখ লাগালে তাকে দেখতে পেতে হবে, আর তার ওপর যথেষ্ট আলো পড়তে হবে। আমার ছোট থেকে বড় হওয়া এই ছবির অ্যালবামগুলিতে বন্দি। আসলে বন্দি বলা ভুল; এই ছবিগুলি সেই মুহূর্তগুলোকে মুক্ত করে দেয়। আমি আমার ছোটবেলার সম্পর্কে বহু কিছু জানতে পারি এই ছবিগুলি থেকে। এই ছবিগুলি না থাকলে সেই মুহূর্তগুলো আমার মনে জায়গা পেত না।

আমি যখন বড় হলাম, আমার বাবা যখন আমাকে একটি ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিলেন, তখন সেই ফ্যামিলি ফটোগ্রাফারের ভূমিকাটা হয়ে গেল আমার। কিন্তু আমি তো বর্তমান যুগের “ফটোগ্রাফার”, আমিতো কম্পোজিশন বুঝি, ফোকাস বুঝি, অ্যাপারচার, শাটার স্পিড এসবও বুঝি। আমার কি আর বাবা মা’র মত ওরকম সাধারণ ছবি তুললে চলবে? আমার ছবির সাবজেক্ট হবে সুন্দর ফুল, ফুলে বসা প্রজাপতি, সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ, তাতে ফটোশপের কারুকার্য। আজ যখন সেই ছবি দেখি, আমার মনে পড়ে না সেই ফুল কোথায় ছিল, সেই প্রজাপতি একটিই ছিল না আরো পাঁচটা ছিল, ফটোশপের কারুকার্যের ঠেলায় সেই গাছের পাতার আসল রং কী ছিল তা আমি ভুলে গেছি। আর এখন আমি আরো অনেক নতুন কায়দা শিখেছি, অনেক বেশি দক্ষতা অর্জন করেছি, সুতরাং সেই ছবি এখন আমার কাছে খুবই সাধারণ।

সন্ধ্যেবেলা চা খেতে খেতে সবাই মিলে বসে যখন বাবা মা’র তোলা সেই “ভুল” ছবি দেখি, তখন আমাদের মুখে হাসি ফোটে, সেই ছবি কত কথাবার্তার সূচনা করে‌। আমার “ফটোগ্রাফি” সেখানে জায়গা পায়না।

একজন খেলোয়ার সারা মাঠে বল নিয়ে যতই দৌড়ে বেড়াক, তার কদর তখনই হয় যখন সে গোল দিতে পারে। আর যদি সে গোল দিয়ে নিজের দলকে জিতিয়ে দেশে গৌরব নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তো কথাই নেই। ঠিক তেমনই, আমি আমার ক্যামেরা চালানোর দক্ষতা ব্যবহার করে যখন একটি গল্প বলতে পারি তখনই আমার সেই দক্ষতার কদর হয়। আর সেই গল্প যদি কাউকে খুশি করতে পারে, বা কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে, তখনই হয় ফটোগ্রাফির উপযুক্ত ব্যবহার, মাধ্যমটি খুঁজে পায় তার উদ্দেশ্য। এই গল্প বলার জন্য কোনো প্রতিযোগিতায় জয়ী হওয়ার প্রয়োজন হয় না, কোনো মেডেল পাওয়ার প্রয়োজন হয় না। শুধু প্রয়োজন হয় একটি উদ্দেশ্য, আর সেই উদ্দেশ্যে পৌঁছানোর উৎসাহ।

এই গল্প বলার কোনো নিয়ম নেই। আমার ছবি আমার নিজের, সেই ছবি নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি। ফটোশপে তার রং বদলে দিতে পারি, তাকে কেটেকুটে টুকরো করে দিতে পারি, চারটে ছবির চারটে টুকরো জুড়ে একটি নতুন ছবি তৈরি করতে পারি, ছবির উপরে কিছু লিখতে পারি, আঁকতে পারি, তাকে কাগজে ছাপতে পারি, কাপড়ে ছাপতে পারি, গাছের পাতায় ছাপতে পারি, খোলা মাঠে ছড়িয়ে দিতে পারি, অথবা সুন্দর করে একটি অ্যালবামে ভরে রাখতে পারি। আমার মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য যা করা প্রয়োজন তাই করতে পারি, কোনো বাধা নেই।

তাহলে ছবি তোলার এই যে এত নিয়ম কানুন, এত পদ্ধতি, এতরকম যন্ত্রপাতি, এর কি কোনো গুরুত্ব নেই?‌ পাশ্চাত্যের সব নিয়মই কি ভুল? এত রকম উন্নত প্রযুক্তি, এর কি কোনো ব্যবহার নেই? অবশ্যই আছে। উদ্দেশ্য ছাড়া কারিগরের দক্ষতার যেমন কোনো মূল্য নেই, তেমনি উন্নত যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি, এবং তা ব্যবহারের দক্ষতা ছাড়া কারিগর তার উদ্দেশ্যে পৌঁছতে পারেনা। উন্নত প্রযুক্তির দক্ষ ব্যবহারে কারিগরের কারিগরির মান আরো উন্নত হয়। কিন্তু সেই প্রযুক্তি না থাকলে যে কারিগরিই হবে না, একথাও ঠিক নয়, আবার প্রযুক্তি থাকলেই যে খুব ভালো কারিগরি হবে, একথাও বলা যায় না। মূল বিষয় হল, আমার কারিগরি কোন সমস্যার সমাধান করে বা কী কাজে লাগে। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এবং নিয়ম পালন করে আমি আমার সমাধানকে আরো সুন্দর, আরো গ্রহণযোগ্য এবং আরো সহজলভ্য করে তুলতে পারি। এতেই এই প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার।

ফটোগ্রাফি করতে আমরা সবাই পারি, এর জন্য কারো বৈধতা স্বীকারের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে, ফটোগ্রাফি মাধ্যমটি অত্যন্ত শক্তিশালী। এর অপব্যবহার, বা দায়িত্বহীন ব্যবহার মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই মাধ্যম যেমন আমরা স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করতে পারি, এই স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য তেমনই আমাদের কিছু দায়বদ্ধতা আছে। ছবির মাধ্যমে কাউকে মানসিক আঘাত দেওয়া, বা কারো ওপর গোপন ভাবে নজর রাখা, কারো শারীরিক, মানসিক, বা আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে স্বার্থসিদ্ধি করা— এগুলি এই মাধ্যমের অপব্যবহার। ফুটপাথের একজন ভিখারির আমার ওপরে কিছু বলার ক্ষমতা নেই বা আমার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই বলেই যে আমি যখন খুশি তার সামনে ক্যামেরা নিয়ে দৌড়ে গিয়ে তার অনুমতি ছাড়াই তার ছবি তুলে নেব, আর একটি সহানুভূতিশীল ক্যাপশন দিয়ে স্ট্রীট ফটোগ্রাফির নামে সেই ছবি আমার শিল্পকলা হিসেবে সারা বিশ্বে দেখিয়ে বেড়াবো, তা ঠিক নয়। এটা খুবই নির্মম, অমানবিক, বিকৃত মানসিকতার পরিচয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রতিদিন হাজার হাজার ফটোগ্রাফার এই কাজই করে চলেছে। কারণ এই ছবি আমাদের মত পাকা বাড়িতে নরম বিছানায় শুয়ে থাকা সুবিধাভোগী মানুষের বিনোদনের খোরাক। আমাদের মত লক্ষ লক্ষ মানুষ রোজ এই ধরনের ছবি “লাইক” করে, এক হাতে চায়ের কাপ আর দুই আঙুলের ফাঁকে সিগারেট নিয়ে ছবির কম্পোজিশনের প্রশংসা করে, এই ছবির এক্সিবিশন করে, কেনা বেচা করে। ছবির নির্মাতা এবং ছবির উপভোক্তা— উভয়‌ই যদি সচেতন থাকে, তাহলে ফটোগ্রাফি করতে আমাদের কার‌ও কোনো বাধা নেই।

—তমোজিৎ বর্ধন (tamojitbardhan@gmail.com)

Leave a Reply

No announcement available or all announcement expired.